ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও ওই সময় বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত ১৩৯৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া কারাগার থেকে পালানো ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ৭০০ আসামিরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০২৪ সালে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এসব অস্ত্র আর অপরাধীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লুণ্ঠিত অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গিয়ে থাকতে পারে। বেহাত অস্ত্র নানা রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা ও অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া যারা কারাগার থেকে পালিয়েছে তাদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও রয়েছে। তারাও আবার অপরাধে জড়িয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্ত্র উদ্ধার ও পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে লুট হওয়া অস্ত্র যেমন উদ্ধারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তেমনি কারাগার থেকে পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে কাজ চলছে।
এদিকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় কিছু পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকা পুরো বাহিনীকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলে দেয়। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের অনেক বড় কর্মকর্তা গা ঢাকা দেন। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এ ছাড়া অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ নানা অভিযোগে মামলা হয়। যে কারণে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যের মনোবল ভেঙে যায়।
লুণ্ঠিত অস্ত্রে অপরাধ
গত ২ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে পরিকল্পিতভাবে প্রেমিকাকে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই সময় মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার গণমাধ্যমকে জানান, ওই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি গত ৫ আগস্ট ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র। এ ঘটনায় আবারও লুণ্ঠিত অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি সামনে আসে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৫ হাজার ৭৫০টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গোলাবারুদ লুট হয়। এর মধ্যে সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। এখনও উদ্ধার হয়নি পুলিশের লুট হওয়া ১ হাজার ৩৯৯টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। এদিকে লুণ্ঠিত গোলাবারুদের মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং ২ লাখ ৬২ হাজার ১৭০টি গোলাবারুদ উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধারে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যসহ পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তারা লুণ্ঠিত অস্ত্র ও অনেক পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এই অভিযান চলমান রয়েছে।’
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই জেল পলাতকদের গ্রেপ্তার ও বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে। পুলিশের সবগুলো ইউনিটই এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু।’
গত ২৮ নভেম্বর ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা থেকে আতাহার আলী নামে দুবারের জেল পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। নরসিংদী কারাগার থেকে গত ১৯ জুলাই পালিয়ে যান তিনি। পরে গ্রেপ্তার করে তাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। ৭ আগস্ট কাশিমপুর কারাগারে হামলা হলে সেখান থেকেও আতাহার আলী পালিয়ে যান।
কারা অধিদপ্তরের প্রধান কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশব্যাপী উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের কয়েকটি কারাগারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বন্দিরা। বাইরে থেকে কোনো কোনো কারাগারে চালানো হয় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। ওই পরিস্থিতিতে কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তসহ বিচারাধীন মামলার ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়। যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তারের পর কারাবন্দি করা হলেও এখনও ৭০০ বন্দি পলাতক রয়েছে। এদের মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ৭০ জন জঙ্গিও রয়েছে।’
লুণ্ঠিত অস্ত্র ও কারাগার থেকে পালানো আসামিদের গ্রেপ্তারে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব) কাজ করছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৬৬টি অস্ত্র ও ২১ হাজারে মতো গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে র্যাব ও পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্রও রয়েছে। আমরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেল পলাতক আসামিদের ধরায় জোর দিচ্ছি। তবে অন্য পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারেও চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া জেল পলাতক ১০০ জনের বেশি আসামিকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি ‘
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ বেড়েছে। এই অপরাধীদের মধ্যে যদি পলাতক আসামি থাকে অথবা তাদের হাতে যদি এই লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকে, তাহলে এটা জনমনে অবশ্যই উৎকণ্ঠা সৃষ্টির কারণ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু অভিযান চালিয়ে এই অস্ত্র উদ্ধার বা পলাতক আসামি গ্রেপ্তার কঠিন হবে। এখানে পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়াতে হবে। এটা এলাকাভিত্তিক করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
মন্তব্য করুন